সীতাকুণ্ডের শিবচতুর্দশী মেলা শুরু ৪ মার্চ
![সীতাকুণ্ডের শিবচতুর্দশী মেলা শুরু ৪ মার্চ](https://eibela.com/upload/1550830806806.jpg)
হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান সীতাকুণ্ডের ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ ধামে তিন দিনব্যাপী শিবচতুর্দশী মেলা শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ৪-৬ মার্চ। তীর্থ যাত্রীদের সার্বিক নিরাপাত্তা, পানীয়জল, পয়ঃপ্রণালী, যাতায়াতের জন্যে ট্রেন-বাসের ব্যবস্থাসহ মেলার যাবতীয় প্রস্তুতির প্রক্রিয়া চলছে। তীর্থ যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধান ও সার্বিক সহায়তাদানের লক্ষ্যে পুলিশ-আনসার-ভিডিপির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাঁচশতাধিক স্বেচ্ছাসেবক সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে।
এছাড়া সীতাকুণ্ড শংকরমঠ, রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রম্মচারি শ্রেবাশ্রম, শ্রী জগন্নাথ সেবাশ্রম, শ্মশ্মান কালী বাড়ি, অনুকুল সৎসঙ্গ আশ্রম, রামঠাকুরের আশ্রম, জন্মাষ্টমী পরিষদ, গীতাশিক্ষা কমিটি, ভোলানন্দ সেবাশ্রমসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন গীতাযজ্ঞ, নাম সংকীর্তন, ধর্মসভা, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
শিবরাত্রিতে ব্যাসকুণ্ডে স্নান-তর্পণ, গয়াকুণ্ডে পিণ্ডদান ও বিভিন্ন মঠমন্দির পরিদর্শন শেষে পূণ্যার্থীরা মেলায় মিলিত হয়। কখন থেকে এ মেলা শুরু হয়েছে তার সঠিক দিনক্ষণ জানা যায়নি। তবে আনুমানিক ৩শ’ বছর যাবত এ মেলা হয়ে আসছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
সীতাকুণ্ডের ঐতিহাসিক তীর্থস্থানের পটভূমি নিয়ে হিন্দুশাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য মেলে। অনেকে মনে করেন, সতীদেবীর স্মৃতিবিজড়িত ‘সতীকুণ্ড’ কালক্রমে বিকৃতির ফলে বর্তমানে সীতাকুণ্ড রূপলাভ করেছে। হিন্দু ধর্মালম্বীদের মতে, শিব লিঙ্গ(অঙ্গ) রূপে এখানে অবস্থান করে এবং সেখানে তিনি সদা জাগ্রত। হিন্দুদের মধ্যে এ ধারণা প্রবল রয়েছে যে, পূর্ণতিথি শিবচতুর্দশীতে এ ধামে স্নান, শিবপুজা এবং ধর্মগ্রন্থ পাঠ বা শ্রবণ করলে জাগতিক পাপ মুছে গিয়ে পূণ্যের সঞ্চার হয়।
ঐতিহ্যবাহী সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ তীর্থ বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্যে অতি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ধর্মীয় শাস্ত্রমতে, সব তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করলেও সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মহাতীর্থ দর্শনে না এলে পূণ্যার্থীদের পূর্ণার্জনে পরিপূর্ণতা আসে না।ধর্মীয় এ বিশ্বাসে দেশ-বিদেশের সনাতন ধর্মালম্বীরা চারযুগ অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলির ঐতিহ্যে লালিত আদিতম তীর্থস্থান শিবালয় ও একান্ন মাতৃপীঠের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র সীতাকুণ্ডে আগমন করেন।সীতাকুণ্ডের উত্তরে বারৈয়াঢালার লবণাক্ষ তীর্থ ও দক্ষিণে বাড়বকুণ্ড তীর্থ পর্যন্ত প্রায় ১২কিলোমিটার ব্যাপী এ তীর্থস্থানের বিস্তৃতি রয়েছে। শিবচতুর্দশী তিথিতে পূণ্যার্থী নরনারীদের এখানে পরিক্রমণ করতে দেখা যায়। মেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও এটি মূলত ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দেশ-বিদেশের অগণিত তীর্থ যাত্রীর সমাগমের ফলে কালক্রমে এটি শিবচতুর্দশী মেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সংসার ত্যাগী সন্যাসীদের জপ-তপ-সাধনা সব কিছু মিলিয়ে প্রেমতলা থেকে চন্দ্রনাথ ধামের পাদদেশ পর্যন্ত বিরাজ করে ভিন্নরকম আবহ। মন্দিরসড়কের দু’পাশে ভাসমান দোকানীরা বসে নানান গৃহস্থালী পণ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের পসরা সাজিয়ে। হিন্দুদের পাশাপাশি সব ধর্মের সব বয়সী মানুষের সমাগমের ফলে এটি একটি সর্বজনীন মেলার মর্যাদা লাভ করেছে। এ মেলা এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন শিবচতুর্দশী মেলা উপলক্ষে তীর্থ যাত্রীদের সুবিধার্থে আলোকসজ্জা, পানীয়জল সরবরাহ, চিকিৎসাসেবা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এছাড়া বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী ও ধর্মীয় সংগঠন তীর্থ যাত্রীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পানীয়জল সরবরাহের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এছাড়া পূণ্যার্থীদের সেবায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ও মেডিকেল টিমও সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকবে। মেলা কমিটি স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দির পর্যন্ত আলোকসজ্জা ও পানীয়জল ও ৩০টি স্বায়ী-অস্বায়ী টয়লেটের ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে তীর্থ যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রথমবারের মতো মানসম্মত একটি ‘স্মরণিকা’ প্রকাশের কাজ চলছে। মেলা কমিটির পক্ষে কেন্দ্রীয় সাউন্ড সিস্টেম সার্বক্ষণিকভাবে সক্রিয় থাকবে। বিগত কয়েক বছর ধরে শিবচর্তুদশী মেলা ও দোলপূর্ণিমার মেলায় অসামাজিক কার্যকলাপ, জুয়া, হাউজি, অশ্লীল নৃত্যের আসর নিষিদ্ধ রয়েছে; এবারও তা বজায় থাকবে।
তীর্থ যাত্রীরা যে সব মঠমন্দির পরিদর্শন করবেন সেগুলো হচ্ছে- কালীবাড়ি, শনিঠাকুরের বাড়ি, প্রেমতলা, মোহান্তের আস্তানাবাড়ি, গিরিশ ধর্মশালা, ব্যাসকুণ্ড, ভৈরবমন্দির, অক্ষয় বট বা বটবৃক্ষ, নারায়ণছত্র, মহাশ্মশান, হনুমান মন্দির, সীতাকুণ্ড, ভবানী মন্দির, স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির, গয়াক্ষেত্র, জগন্নাথ মন্দির, ছত্রশিলা, কপিলা আশ্রম, ঊনকোটিশিবের বাড়ি, বিরূপাক্ষ মন্দির, পাতালপুরী, চন্দ্রনাথ ধাম, জ্বালামুখি কালিবাড়ি, বাড়বকুণ্ড, অন্নপূর্ণা মন্দির, দধিকুণ্ড, লবণাক্ষকুণ্ড, গুরুধনী, ব্রম্মকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড, চম্পকেশ্বর মন্দির ও কুমিরার কুমারীকুণ্ড। এ সব মঠমন্দির দর্শন শেষে পূণ্যার্থীরা মেলায় যায় এবং সখের জিনিসপত্র কিনে গন্তব্যে ফিরে যায়।
এবারের চতুর্দশী তিথি সময় ৪ মার্চ সোমবার বিকেল ৫-৩৪ মিনিটে শুরু হয়ে ২৪ঘণ্টা স্থায়ী থাকবে। এই সময়ের মধ্যে পূণ্যার্থীরা তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন। মেলার পনেরো দিন পর অর্থাৎ ২০-২১ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে দোলপূর্ণিমার মেলা। বলা যায়, শিবচর্তুদশী মেলার রেশ পক্ষকালব্যাপী থাকবে।
No comments: